দিবাস্বপ্ন: দেবজ্যোতি রায়
দিবাস্বপ্ন হলো এমন
একটা ব্যাপার যা একজন মন্ত্রী, আমলা, বিচারক থেকে শুরু করে কিম্বা তৃতীয় শ্রেণির নেতা, সরকারি
অফিসের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীটি পর্যন্ত সবাই দেখে এমনকি একটা তালগাছও। এবং এটাও
স্বতঃসিদ্ধ যে প্রত্যেকের দিবাস্বপ্ন একইপ্রকার হয় না। মন্ত্রী ও বিচারকের মধ্যে,
আমলা ও তৃতীয় শ্রেণির নেতার মধ্যে, এমনকি
সরকারি অফিসের কেরানি ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীটির দিবাস্বপ্নের মধ্যেও এবং
অবশ্যই তালগাছ, যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত পার্থক্য, একজন লটারি বিক্রেতা ও যে লটারি কেনে দু'জনেই কি
একইপ্রকার দিবাস্বপ্ন দেখে? কিম্বা বড়বাজারের গদিতে
বিপুলায়তন মধ্যপ্রাচ্যে ঢাকা পড়ে গেছে যে লোকটা আর যে লোকটা মাল ওজন করে এদের দু'জনের দিবাস্বপ্নেও থাকে বেড়াল ও ইঁদুরের লুকোচুরি খেলবার দূরত্ব ও
যৌক্তিকতা। যদিও একথা বলা হয়ে থাকে যে অধিকাংশ দিবাস্বপ্নের মধ্যেই যৌনতা কাপড়
খুলে নিতম্বের ঝকঝকে আধুনিকতাকে দেখে এর বাইরেও অন্য নানাপ্রকার দিবাস্বপ্ন থাকে ও
থাকবে যেমন মন্ত্রীমহোদয়ের দিবাস্বপ্নে আসে সেই শাশ্বত চেয়ারটা যা একটা প্রকাণ্ড
কুমির মাথায় নিয়ে ঘোরে অথবা বিচারক দেখেন এমন একটা বিচারব্যবস্থা যেখানে প্রতিটি
ভুল সিদ্ধান্তের জন্য দেবদূতদের থেকে পুরস্কৃত হবার সম্ভাবনা থেকে যায়, একজন উকিল দেখে এই দিবাস্বপ্ন যে বাদী ও বিবাদী তার কাছে এসে একই ঘাটের জল
খাচ্ছে ও যাবার সময় গুণে দিয়ে যাচ্ছে দোতলা মাশুল, কাঠগড়া
থেকে নেমে যাচ্ছে অপরাধী সে পা বাড়াবে মুক্ত জীবনের দিকে, যেমন
নেতার দিবাস্বপ্নে ভিড় করে আসে লক্ষ লক্ষ শাদা ভেড়া তার নামে জয়ধ্বনি দিতে দিতে
দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছে নির্বাচনী বুথগুলির দিকে এবং আমলা দেখেন এমন এক দপ্তরের
স্বপ্ন যেখানে কোনো জন্মেও কোনো কাজ হবে না অথচ বাজেট বরাদ্দ বাড়তেই থাকবে। একজন
কেরানি যখন দিবাস্বপ্নে বেলা একটা থেকে চারটে পর্যন্ত টেবিলে হাত-পা তুলে নিজেকে
ঘুমাতে দেখে তখন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীটির স্বপ্নে বেল টিপতেই স্বয়ং অধিকর্তা
এসে বাড়িয়ে দেন একগ্লাস ঠান্ডা পানীয়। একটিও ছাত্রকে না পড়িয়ে একজন শিক্ষক তার
স্বপ্নের লটারিতে জাতীয় শিক্ষকের খেতাব জিতে নেন এবং একজন চিকিৎসক তার বাড়ির সামনে
দেখেন সেইসব রোগীদেরও ভিড় যাদের ডেথ-সার্টিফিকেটে তিনি নিজে সই করেছিলেন, তদুপরি তার বউয়ের জন্য আনা নখ-পালিশের একটা বিদেশি মেশিন যেজন্য তাকে একটি
পয়সাও খরচ করতে হয়নি। আর একটা তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে আকাশে পাখি হয়ে উড়ে যাবার
দিবাস্বপ্ন দেখে। তবে সবচেয়ে রিমার্কেবল দিবাস্বপ্ন দেখেছিল আমগাছটার ডালে বসে
একবার একটা ছোট্ট দোয়েল যা সে আমার পড়ার টেবিলের জানলায় বসে আমাকে শুনিয়েছিল। সে
দেখেছিল গতবারের 'বিশ্বসুন্দরী' খেতাব
জেতা একটা মাদী জলহস্তী স্বয়ম্বর সভায় তার গলায় পরিয়ে দিচ্ছে বরমাল্য আর প্রতিটি
পরশ্রীকাতর ঠোঁট চোখে মেখে নিচ্ছে এমন একটা নির্লিপ্তি যেন কস্মিনকালেও তারা
স্বপ্ন দেখেনি একজন বিশ্বসুন্দরীর সঙ্গে নিজেকে এক খাটে। এবং আমার কবিবন্ধুটি
প্রতিদিন দিবাস্বপ্নে জীবনানন্দের পাশে যে চেয়ারটা এখনো খালি পড়ে আছে সেখানে গিয়ে
বসে, হাতে তার জীবনানন্দের ফেলে দেওয়া একটা পুরনো ভাঙা কলম।
পুনশ্চঃ এবং মৃতরাও
দিবাস্বপ্ন দেখে, দেখে জীবন ও জীবিতদেরকে,
তখন আঁৎকে উঠে আরো একবার তারা যে-যার চিতার আগুনে ঢুকে যায়।
ভালো লাগল।যদিও দেবজ্যোতি রায়ের এর চেয়ে অনেক ভালো লেখা আগে আমি পড়েছি।
ReplyDeleteধন্যবাদ
Deleteবাবু দা, তোমার গদ্যের মতোই এই গদ্য, যা আমাকে মুগ্ধ করে সবসময়ই। আসলে ঈপ্সা এবং ইচ্ছা চরিতার্থ করার রোমাঞ্চ থেকে কোন জীবই নিষ্কৃতি পায় না। এটা "দিবাস্বপ্ন"এর মধ্য দিয়ে পাঠকের (আমার) ভেতর চারিয়ে দিতে পেরেছো। এই যে নিজেকে খুলে দেখা - এ তো এখন আর নেই মানুষের মধ্যে, ফলে সমাজেও নেই। ধন্যবাদ তোমার এই লেখার জন্য ।
ReplyDeleteধন্যবাদ কল্যাণ
Deleteলেখাটায় তোমার সিগনেচার কোথাও কোথাও উধাও হয়েছে।অবশ্য প্রথমেই লিখেছো তাড়াহুড়ো করে লেখা।তবে শেষ লাইনে এসে আবার সেই পরিচিত দেবুদা।ভালোবাসা জানাই দাদা।---শৌভিক দত্ত
ReplyDeleteধন্যবাদ শৌভিক
Deleteধন্যবাদ শৌভিক
ReplyDelete