সুকান্ত দাসের আলোপাত—প্রথম দশক ও আরও কিছুটা ১

 


গ্রস্থবাদ ও সামাজিক চাপানউতোর: দেবরাজ দে ও অনিমেষ সরকারের কবিতা

 

কবির বই বকলমে কবিতা বিষয়ক আলোচনা একপ্রকার আত্মহননের সমার্থক শব্দই প্রায়! আপাতত ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছি প্রথম দশকে। ইবলিশের আয়োজনে সুতো ছাড়া হল। দেখা যাক ঘুড়ি কতখানি দূরত্ব বুঝে নেয়।

 

"দোকানী হেসেছিল, "কী সব চিন্তা করো..."

সহানুভূতি জানিয়েছিল, 'এসো না একটি দলে'

রাস্তা দেখিয়েছিল, এ দেখাটার যন্ত্রণা ভুলিয়ে দেওয়ার"

                                                 (সে পারবে না)

 

দেবরাজ দে। জন্ম কোচবিহারের শিল্পাঞ্চল চকচকায়। একটিমাত্র কাব্যগ্রন্থ "কৌণিক।" নিরাশার ঘেরাটোপে যখন কেউ দিন গুজরান করে এটা জেনেও যে তার পরিচয় কোন ইতর বিশেষ নয় কিন্তু কি তার পথ? প্রশ্নবাণের উত্তরে রূপকের ভেতর পালক পড়ে থাকে। রাজনৈতিক চেতনা তাকে আবিরে রাঙিয়ে তোলে। সে লেখে

"আমি মূক-অভিনয়

ছল হলেও অন্ধকার বুক

....

সবাই তো পরে নিয়েছে কাজল

এভাবেই, আমার ক্ষুধার্ত বৃত্তি, সম্পর্ক গড়ে ক্লেশে

আমি সবকিছু ছাড়লেও, পাশে জিরোন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা

দুজনে ধরে আছে আয়না, অলীক তাদের স্বপ্ন বুনোট

....

যে নিবিড় স্বপ্ন ঘেরাটোপে একটি ছেলে জন্মায়

সেখান থেকে দূরে নগর-প্রহরীকে ভৎর্সনা

মুগ্ধবোধ আহ্বান জানায়

ঈগল ছুটে আসে, 'কামড়ালে তুইও পাবি ডানা"

 

প্রতিবিম্ব ছড়িয়ে দিয়েছেন। রুপোলি তমসুকও। যদিও সমস্যা যুগকেন্দ্রিক হয়। দেবরাজ হাঁটছেন খালাসী পট্টির উগ্র রামের দোকান, চকচকার মাঠে জোছনা রাতের রোমাঞ্চ আর বয়ে নিয়ে চলা আত্মশ্বাস নিয়ে।

ঠোক্কর খেয়ে গড়িয়ে যাচ্ছেন উপত্যকা বেয়ে পরমুহূর্তেই চেতনাবন্দী করছেন,

 

"একটি ছবিতে আমি যাব

যে ছবি সঞ্চরণশীল"

                          (নির-বাদ)

"দুঃখীর জ্বলন্ত চোখ - এবার?

তোমার জন্যও আছে সংরক্ষণ,

                                    কর দল

নিজেকে হারাতেই তো এসেছি"

 

কতখানি অভিযোগ জমা হলে তবে নৌকা ছাড়বে ঘাট? প্রথম কথাগুলো স্টেটমেন্টধর্মী। আজকাল পরশুর গল্প কিন্তু পরমুহূর্তেই নিজের সাথে মাপজোক। দেশজুড়ে নৈরাশ্যবাদের ঢেউ যে তাকে আছড়ে ফেলে! কবি কি পারছেন অবলীলায় নিজেকে সংবরণ করতে?

 

"সমস্যা এড়িয়ে চলা এক ধরণের ঘুম

ভেঙ্গে পড়ার পর প্রায় সব কিছুই গ্রস্থ"

 

মনে পড়ে সে সময়টায় noir, বাংলা তর্জমা আমাদের কাছে ছিল 'গ্রস্থ।'  আর এই অভিধা ছিল আমাদের কাছে উত্তেজনাময়। সদ্য শেখা হয়েছে --'তোমার এখন প্রয়োজন দিক পরিবর্তন।' আলোচনার নিরিখে পৃথিবী এক সুতোয় গেঁথে দেওয়া যায়। সমস্যা মানবকেন্দ্রিকও বটে!

 

"ছেলে বশে রাখতে মা: কবিরাজের ওষুধ

ছোট বয়সী ছেলের কামনা

অন্তর্মুখ যেন, ভালোলাগার দিক খোঁজে

....

মানুষ বুঝতে পারে সে তার ভুল শিশির হারিয়েছে"

 

আত্মকোলাহল জাগে। বসতির দিক ভেঙ্গে হাত বাড়ায় যেখানে কালোছায়া আরো বেশি। ইডিপাস কমপ্লেক্স ঘুণপোকা কিনা সঠিক উত্তর হবেনা। সংক্ষিপ্ত দেখা। বিপরীত দিকে ভাসা ভাসা আলোড়ন আজ প্রায় প্রতিটি পরিবার বহন করছে। পরকিয়াও স্বাধীন প্যারামিটারের ভূমিকা তুলে ধরে। অন্তত দাবী জানাচ্ছে। কবি জানেন তার প্রতিষেধক কিন্তু সে তো অন্তর্মুখী। ভয় পান শীতকালকে। এই ভারে তার জুবুথুবু ভাব আদৌ কি হবে? কিভাবে হবে? নাকি শুধু ডালপাতার ছাঁই ঢিপি করে রাখা ছাড়া?

 

 

অনিমেষ সরকার। পাহাড়তলী চালসার ছেলে। প্রথম কবিতার বই "নপুংসক ফিনিক্স।" এ দশকের কিছুটা পরে লিখতে আসা অনিমেষ লেখেন

"ধানের সংজ্ঞা দেওয়ার মতো অভিধান আছে ওই দেশে

পাহাড় ঘুমোলে"

 

এছাড়াও

 

"হাঁড়িতে পৃথিবী রচনা হচ্ছে শেষবারের মতো অক্ষর নয়

আগামীকাল ভাত খেতে পারব চাল সেদ্ধ হয়ে এলে"

 

আবার কোথাও লিখেছেন

 

"তারপর যে কথাগুলোর কাগজ আমি জমিয়েছিলাম

একটু একটু করে ছিঁড়ে দেবো"

 

ক্রাইসিসের সাথে প্রেমের শিরোনাম একই বন্ধনীতে। অস্বীকারের ভাবনা যুক্তিগ্রাহ্য বিচারে না করাই সুন্দর। কবির ভৌগোলিক অবস্থান তাকে রুক্ষ জমিতে টেনে নিয়ে আসে যেখানে 'ভাত' একটি মাইটোকন্ড্রিয়া। কবির অনেক কবিতায় ভাতের উল্লেখ পাই। সে তো স্মার্ট করে লেখার বয়ান জানে। তবুও পারেনি নিজেকে ছাড়াতে। এ তবে অতি প্রাসঙ্গিক। বচেতনের ঘোরে উঠে আসা। আর প্রেম! জমিয়ে রাখার মতো মানসিকতা কি এখন আসে? প্রতিটা ভোরেই আমরা কতটা অবস্থান বদলে ফেলি। সোজা মনের ঘরে টোল পড়েনা। চেনা পরিবেশের হাত ধরে সে বলে ফেলে, "একটু একটু করে ছিঁড়ে দেওয়া"

বাবার ভেতর একটা বাক্স আছে .. হিংসা, কষ্ট

কবিতা, দেশ, জলপথ, কামান

 

যেন সব পেয়েছির দেশ। শূন্যতা অনিমেষকে শোকস্তব্ধ করে। বজ্রনাদের মতো ধ্বনিত হয় বুকের ভেতর। যে কটা শিকড় জেগে আছে তার মুহূর্মুহ প্রেম। আবার লেখে

"বাবার কলমে মাসকাবারি বাজার

একটা সুস্পষ্ট লাইন" ..

 

এক অদ্ভুত অপত্য প্রেম আমাদের তরঙ্গায়িত করে। সত্যিই তো যদি জিয়নকাঠি সকলের কাছেই থাকতো!!

 

আমার বোধের গাছ থেকে শহর খুলে নারী হও

                                                               (নারী)

শীৎকারের ভেতর একটা দেশ বেড়ে উঠছে

                                                  (হারমোনি)

 

কবির ভেতরকার চেতনা তিলতিল করে একটা অবয়ব তৈরি করল। এরকম বহু অবয়ব মিলেমিশে একটা শহর দেশ গ্রাম হয়ে যায়। সে বহুরৈখিক সমীকরণ মেলাতে বসে। জন্মপ্রদান ক্ষমতা নিয়ে ভাবাতুর হয়। এক্ষেত্রে হারমোনি তির্যক শ্লেষ ব্যতীত আর কিই বা হতে পারে!!

 

তবে সময়ের আবেগ ধরতে তৎক্ষণাৎ, সুগার ফ্রী, চার্জার পয়েন্ট শব্দগুলো অনেক ক্ষেত্রে লেখার মানকে ক্ষত করলেও অনিমেষের পরবর্তী জীবনবোধ তাকে আরো  পরিণত করবে এ প্রত্যাশার ইঙ্গিত সে রেখেছে। তাঁর ক্ষুরধার লেখার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

No comments:

Post a Comment

ইবলিশ ৭ - নিরোর নগরকীর্তন ও তাহার নাগরবৃন্দ

  শিল্পী: জস এ. স্মিথ  সম্পাদক কয়  নিরোর নগরকীর্তন ও তাহার নাগরবৃন্দ বাঁশি না বীণা না বেহালা কী বাজাতেন নিরো?—কেউ হয়তো জানে ঠিকটা। বাদ্যযন্ত...