নিরোরা নোয়া হতে চায়নি কখনো: প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
প্রকৃতপ্রস্তাবে—(আ-বিশ্ব)চলছে
জমজমাট পালাগান: বাঁচার অধিকার বনাম খতম-অভিযান। চলছে চারিধারে, নির্বিবাদে।
ধিকিধিকি জ্বলছে শতশত চিতার হুতাশন। মৃতের স্তূপ এখন স্বদেশ আমার, মহেঞ্জোদড়
বিলক্ষণ। প্রায় পাঁচশো রজনী পার করল হেলায় (অবহেলায়?),
তবু ক্ষান্তি নেই তার। বাজার
বিশ্বায়ন, বিশ্ব যুদ্ধায়ন। অস্ত্র-শস্ত্র, ক্রুদ্ধ
যুদ্ধ—তারই পিঠোপিঠি—ফের পুনর্বাসন,
ত্রাণ। আ-বিশ্ব পুজো
পান–বাবা পঞ্চানন: ট্রাম্প-মোদি-বোলসেনারাই–পুটিন-বরিস জনসন। একবিংশের বিশ্বে,
বস্তুত,—নিরোরাই
এখন বহুবচন।
এই
প্রবন্ধের জন্য বেছে নিয়েছি নেক্রোপলিটিক্স,
নেক্রো-ইকনমি, 'কিলেবল', প্যান্ডেমিক, 'লেটিং
ডাই' বা 'মেকিং ডাই'
এর মতো এযাবৎ অপরিচিত কিছু শব্দাবলি এবং সেইসব
কয়েনেজের উদঘাটনকারী ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল ও ইন্ট্যারন্যাশানাল
স্টাডিজ শাখার অধ্যাপিকা ইভ ডারিয়ান স্মিথ-এর "ডায়িং ফর দি ইকনমিঃ ডিজপোসজেবল
পিপল অ্যান্ড ইকনমিজ অফ ডেথ ইন দি গ্লোবাল নর্থ''
শিরোনামের একটি তত্ত্ব-তথ্যে
পরিপূর্ণ একটি লেখা। শোষণপটু ধনবাদের দীর্ঘ চার পাঁচশো বছরের ইতিহাসের প্রেক্ষিত
অনুসন্ধান করে লেখিকা জানিয়েছেন যে ধনবাদের সঙ্গে মৃত্যুবিভীষিকা আদতে
অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত এবং এইসব নিধনযজ্ঞের মধ্যে কয়েকটি অন্তত ধনবাদেরই গভীরে নিহিত 'pre-calculated collateral loss of life' বা পূর্বনির্ধারিত সমান্তরাল/সমপার্শ্বিক
জীবনহানি। চলুন, খুঁড়ে দেখি!
প্রায়
বছর পঞ্চাশেক আগে ফরাসি তাত্ত্বিক মিশেল ফুকো 'bio-power'-তত্ত্বটি দুনিয়ার বৌদ্ধিক সমাজের সামনে পেশ
করেছিলেন। তাঁর ব্যাখ্যায় 'বায়ো-পাওয়ার'-এর অর্থ হল ছলে–বলে-কৌশলে, ভিন্ন-বিভিন্ন
উপায়ে নাগরিকের শরীরের ওপর কর্তৃত্ব হাসিল করা এবং সেইসূত্রে জনগণেশের 'নিয়ন্ত্রণ'।
ফুকোর কথায় "an explosion of numerous and diverse techniques for
achieving the subjugations of bodies and the control of populations".(সূত্র উইকিপিডিয়া)। বায়োপাওয়ার হল গোষ্ঠীভুক্ত
বিশাল জনসমাজকে ম্যানেজ করা = বশংবদ রাখার একটি পন্থা। এই ধরনের রাজনৈতিক কৌশলের
বিশেষত্ব হল সমগ্র জনসংখ্যার নিয়ন্ত্রণ। এইসূত্রেই আধুনিক জাতিরাষ্ট্রগুলো বা
ধনবাদের বিকাশ সম্ভবপর হয়েছে। এককথায়,
বায়োপাওয়ারের অর্থ হল
নাগরিকের শরীর ও স্বাস্থ্যের ওপর রাষ্ট্রিক নিয়ন্ত্রণ। উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে যে
ফুকোর biopower তত্ত্বকে পাব্লিক হেলথ বা নাগরিক স্বাস্থ্যবিষয়ে
ব্যবহার করা হয়েছে। এবং—ফুকোর রচনা থেকেই উদ্বুদ্ধ হয়ে পরবর্তীকালে ' bio-politics,' তত্ত্বের
জন্ম হয়েছে। বলা হয় যে বায়োপলিটিক্স-এর মাধ্যমে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র, আইনি
ও সামাজিক অনুশাসনবদ্ধতার মধ্যে থেকেই,
কীভাবে তার নাগরিকবৃন্দের
বাঁচা-মরার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সংক্ষেপে,
বায়োপলিটিক্সের অর্থ হল
রাজনীতিকদের জনগণতান্ত্রিকতার প্রধান অভিমুখ। ফুকোর অভিমত অনুযায়ী খ্রিস্টীয়
সতেরো-আঠেরো শতক থেকেই এই প্রবণতাটি ক্রমবর্ধমান ছিল এবং উনিশ শতকে পৌঁছে তা
ধনবাদের মাধমে পূর্ণত প্রকাশ পায়। Biopower-এর মাধ্যমে সুনিয়ন্ত্রিতভাবে মানুষের শরীর
উৎপাদন ব্যবস্থা ও অর্থব্যবস্থাগত পদ্ধতির
মধ্যে সহজেই অঙ্গীভূত হয়। এইসূত্রেই আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার উদ্ভব হলে
যুদ্ধ-টুদ্ধের সূত্রে মাস কিলিং বা 'গণহত্যার'ও যাথার্থ্য খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রথম
বিশ্বযুদ্ধের নারকীয়তার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল নাকি অত্যাধুনিকতার খামোশ দেওয়াল।
যুদ্ধের লাগোয়াই কতশত ঘরেলু চৌহদ্দির পরিসীমায় টাঙ্গানো হয়েছিল ইমেজিস্ট, কিউবিস্ট, ইম্প্রেশনিস্ট, সুররিয়ালিস্ট
অথবা দাদাইস্ট কিংবা আরো অনেক, ভিন্ন ভিন্ন ধরনের শিল্পসুষমার
চিহ্-প্রতীক-উপলব্ধি। বলা হয়, এ হল মানবিক সভ্যতার সর্বোচ্চ পরাকাষ্ঠা:
শিল্প-সংস্কৃতির ‘গ্রহণীয়’-কাম-অনুকরণীয় দিক। কিন্তু নব্য-আধুনিকতায় যে আরো একটি
অতি জরুরি (কারো কারো মতে অতি বদরসিক,
কদাকার শব্দ) ‘বাইনারি’, থুড়ি, দ্বিত্ব-দ্বৈবিধ্যেরও
জন্ম হয়েছিল। এহেন ‘বাইনারি’ অনুসারে গ্রহণীয়তার উল্টোপিঠেই কিন্তু বর্জনীয়তার
বসবাস = ওই তো যেকোনো হৃদয় যেভাবে একইসাথে ঘৃণা ও ভালোবাসাকে পুষতে পারে।
'নিরোর নগর কীর্তন ও তাহার নাগরবৃন্দ' শীর্ষক
লেখাটির এই পর্যন্তই বস্তুত ' অলকানন্দা স্বরূপিনী ভূমিকাপর্ব ছিল। পাহাড়ি
ঝোরার মত নিজস্ব ছন্দে গুনাগুনাইতেছিল,
অগ্রসরমাণ ছিল। সহসা এক্ষণে, ১৫ই
মে, ২০২১-য়ের সন্ধ্যা ৯.৫৭ মি গতে, বাস্তবিক
এক পরিবর্তিত পটভূমিতে অকস্মাৎ তাহার সমতল-প্রাপ্তি ঘটিল। এলায়িত মৃদুগতির বহতা
ধারাস্বরূপিণী হইয়া উঠিল। কারণ— আজই সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় নগরীতে লকডাউন ঘোষণার
পিঠোপিঠি লণ্ডনের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামের এফ-এ কাপের অনুষ্ঠানে ফুটবল বিশেষজ্ঞদের 'মাক্সবিহীন' কোলাকুলি, পরিপূর্ণ
দর্শকাসনে পতাকা ও হল্লাবোলের হুহুংকার বোলবালা টিভিতে দৃশ্যমান হইল। না, হুহুঙ্কার
বলার সময় এখনো আসেনি। তবে, সবিস্ময়ে লক্ষ করিলাম "রাজা মিথ্যা, রাষ্ট্র
মিথ্যা, সীমা সরহদ্দ মিথ্যা"-র অগুণতি পোস্টার। সুতরাং, পূর্বাহ্নে
রচিত প্রথম চারটি প্যারার ভূমিকাপর্বটিকে অপরিবর্তিত রাখিলাম। ভাবিলাম, দ্বিতীয়ের
ভিন্নপাঠটির পাশেই বরং প্রথম শব্দছবিটি টাঙ্গানো থাক। 'সেকেণ্ড
ওয়েভ' পার করিয়া ইংলণ্ড ‘আজ খুলিয়াছে দ্বার"। মানুষ সেখানে
মানুষের মতোই সামাজিক আবার। এ কি জেনেশুনে
বিষপান? টিকাকরণ কি সেইদেশে সম্পূর্ণ সমাপ্ত? অর্থ
হয়, স্রেফ অপ্রস্তুত থাকিবার কারণে প্রথম ওয়েভে ধরাশায়ী না
হওয়া কলকাতা দ্বিতীয় ওয়েভটি সামলাইতে পারিল না! আইনজীবী সুভাষ দত্তের মতো আমারও
(বেয়াক্কিলে?) প্রশ্ন-'এ কি রোগের বাণিজ্যিকরণ কিংবা
রাজনীতিকরণ/পলিটিসাইজেশন? দ্বিতীয় ওয়েভে,
সহসা, এতো
মৃত্যু কেন? কেন এতো চিতা বহ্নিমাণ?
নেত্ররোগ বস্তুত রাজার ভূষণ।
জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্র। গান্ধারীও দেখেন না তাই। সেই দিন থেকে, ভারতভূমিতে, অস্বচ্ছদর্শন
রাজকীয় লক্ষণ। সবই অতঃপর সঞ্জয়-উবাচ হকিকত।
রিয়াল
মাদ্রিদ বনাম চেলসির খেলায় বিশ্ববিখ্যাত দুই কোচ থমাস টুচেল (জার্মান)ও জিনেদিন
জিদানের (ফরাসি)মাস্কবিহীন কোলাকুলি দেখে ৮ই মে রাতেই প্রশ্ন জেগেছিল মনে: — এ কি
চূড়ান্ত লাপরবাহী? কিন্তু জয়ের আনন্দে ভুলিয়া গিয়াছিলাম। এক্ষণে, দর্শক-ভরা
ওয়েম্বলি দেখিয়া ভিসুভিয়স হইল মন, লাভা উদ্গীরণ করিল ফের "কেন লকডাউন
পুনর্বার? আমরা কি পরাজিত,
তাহলে?' পুবমুখো
ঢল নামিল কথাস্রোতের কী-বোর্ডে! সংক্ষেপে লিখি দুহাজার একুশের উপসংহার: বিশ্বায়নী
পৃথিবী নিছকই একটি (ধন-ধান্য পূর্ণ কল্পিত) গ্রাম নয় এখন আর। একটি শহর লাগোয়া
‘দুঃস্থ’ শহরতলি বরং।
প্রথম
বিশ্বযুদ্ধকে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল মানবসভ্যতার সেই যুদ্ধ, যা
নাকি যুদ্ধকেই পৃথিবী থেকে চিরতরে মুছে দেবেঃ ‘the
War to End All Wars। কিন্তু অমানবিকতার চূড়ান্ত নির্দশন হয়ে তারা
ফিরে ফিরে আসে। যেমন এসেছিল আগেও ১৯৪৩-এ,
সতেরোশো ঊনসত্তরে কিংবা
উপসাগরীয় যুদ্ধ-টুইনটাওয়ারের বকলমে। পোস্টারের ঢংয়ে শক্তির সেই অমোঘ লাইনটার মতো
আমাদের রাজ্যেও তো প্রত্যক্ষ করেছি ‘আনন্দমার্গী’,
২০০৬-৭, শীতলকুচির
একুশ’ ইত্যাদি লেবেল সাঁটানো “অন্ধকার অনুভবের ঘরে সারি সারি … ভাঁড়ারের নুনমশলার
পাত্র”।।
বিশেষজ্ঞজন
বলছেন যে মানুষ মারার কল বস্তুত ধনবাদ। প্রথমেই ঝাড়বাছাই করে বেছে নেওয়া হয় কারা
কারা “কিলেবল”, থুড়ি, নিধনযোগ্য কোন কোন জন। ধনবাদে মৃত্যুই
মূল্যমান: একশ্রেণির রাষ্ট্রনায়কের পরম কাঙ্খিত মূলধন!!! রোয়াণ্ডা বা সার্বিয়ান
এথনিক ক্লিনসিং, হলোকস্ট
বা প্রোগ্রামড্ জেনোসাইড: আপনি দিতে পারেন তার অন্য যে কোনো নাম। কিন্তু সেই একই
বিধান: ধনবাদে মৃত্যুই মূল্যমাণ—সতেরো শতক হোক কিংবা একুশ...সেই একই ধুন, পুরোনো
পাঁচালি-কাব্য তার; কলেরা-করোনা-টাইফয়েড আখ্যান। ধনবাদে মৃত্যুই মূলধন: চেরি
ব্লসমড্ অর্থনৈতিক বাখান। ফাতমির হাশকাজ অকপটে জানান— 'death as a source of value marks a new space in
capital…that profits in killing and death' তাঁরই লেখায় পাই -'নেক্রো-ইকনমি’র সন্ধান। ফাতমির লেখেন যে ফুকো
কথিত “বায়োপলিটিক্স’ নয়, কিংবা ‘বায়ো-পাওয়ার’ও নয়; এমনকি, রাষ্ট্রশক্তির
সার্বভৌম ক্ষমতা নির্ভর রাষ্ট্রিক জনগণের বাঁচা-মরার অধিকার (অর্থাৎ, রাষ্ট্রিক
ক্ষমতা, যা ঠিক করে 'বধ্য'
কোনজন, আর
কার আছে বাঁচার অধিকার)—তেমনতর “অব গোলি খা'-গোছের না-ইন্সাফির সুবিচারও নয়, নেক্রোইকনমি
হল সেই অর্থনীতি, যা জীবনের ওপর নয় বরং সরাসরিভাবে মৃত্যুর ওপর নির্ভরশীল।
আধুনিক ধনবাদী ব্যবস্থায়, ফাতমির হাসকাজ জানাচ্ছেন “it
is this dying and death that becomes commodified’। অর্থ
হয়, মিশেল ফুকো কথিত বায়োশক্তি (biopower) বা
বায়োরাজনীতি (biopolitics) নয়—বিশ্বের বড়ো বড়ো অর্থনীতিগুলো এখন
নেক্রোইকনমি বা শবকেন্দ্রিক অর্থনীতিতে বেশ সড়োগড়ো হয়ে উঠছে।
মিশেল
ফুকোর থেকে কয়েক ধাপ এগিয়ে ফাতমির হাস্কাজ বা দারিয়ান স্মিথের মতোন অত্যাধুনিক
সমাজশাস্ত্রীরা বরং দেশের ও দশের মঙ্গলার্থে (এবং Covid-19 গোছের অতিমারীর প্রেক্ষাপটে "ডায়িং ফর
দি ইকনমি'
বা 'অর্থনীতির
জন্য মৃত্যু-দাওয়াই' গোছের ভাব-ভাবনায় জারিত হয়েছেন। ওয়েলফেয়ার অর্থনীতির
প্রেমিক আমরা কি প্রশ্ন করব না–'একেই কি বলে সভ্যতা? 'বস্তুত, আমেরিকা
যখন কোভিদ আক্রমণে জর্জরিত, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সহযোগী প্রশাসক এবং
রিপাব্লিকান পার্টির সদস্যরা তখন মার্কিনসমাজের সার্বিক উন্নতির স্বার্থে এবং
প্যাণ্ডেমিক ও লকডাউনের প্রকোপ থেকে মার্কিনী অর্থনীতিকে বাঁচাতে এই 'ডায়িং
ফর দি ইকনমি' তত্ত্বের বিচারবিমর্ষ করেছিলেন। দারিয়ান স্মিথ লিখেছেন যে 'অধিকাংশ
মানুষের কাছে খানিক অদ্ভুত শোনালেও বাস্তবিক পরিস্থিতির স্বার্থে আমি সওয়াল করতে
চাই যে কর্পোরেট সেক্টর ও ব্যবসায়ীদের মন জুগিয়ে চলা রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেই মনে
করেন যে প্রাণবন্ত একটি অর্থনীতির জন্য কিছু মানুষের প্রাণোৎসর্গকেও মেনে নেওয়া
যেতে পারে। দারিয়ান স্মিথ সেইসূত্রে ধনবাদ ও মৃত্যুর মধ্যে বহুদিনের পারস্পরিক (ও
ঐতিহাসিক ) সম্পর্কের কথা পেড়েছেন। আমরাও কি একইরকমভাবে ছিয়াত্তর বা তেতাল্লিশের
মন্বন্তর, ছেচল্লিশের
দাঙ্গা, আনন্দমার্গী,
২০০৬-৭-য়ের নন্দীগ্রাম বা ২০২১-এর শীতলকুচির প্রসঙ্গ কি
এড়িয়ে যেতে পারি? কিংবা কোভিদ নামক অতিমারীর সময়ে সরকারি ব্যর্থতা ও
ঔদাসীন্যের বিষয়ে নির্লিপ্ত থাকতে পারি?
ফাতমির হাস্কাজ তো
নির্দ্বিধায় জানিয়েছেন যে ফুকো কথিত বায়োপাওয়ার বা পরবর্তীকালের বায়োলিটিক্স, বস্তুত, নেক্রোপলিটিক্স
বা নেক্রোইকনমি থেকে সম্পূর্ণত ভিন্ন কারণ নেক্রোইকনমি, হাসকাজের
ভাষায় 'is invested not in life
but rather in death directly and it is this dying and death that becomes
commodified''. ফাতমির এ ধরনের
অর্থব্যবস্থাকে নতুন ধরনের প্রবণতা আখ্যা দিয়ে বলেছেন এই নতুন অর্থনীতি এবং
মৃত্যুর বাজারিকরণকে ঘিরে যেঁ নতুনতর প্রবণতা দেখা দিয়েছে, সে
বিষয়ে তিনি আরোও আলোকপাত করতে চান। কিডনি-কর্ণিয়া বা মানবশরীরের অনান্য অংশ বা
টিস্যু বিক্রি করার মতো অবৈধ কারবার নয় এই নেক্রইকনমি। কারণ পরোক্ষভাবে বা
সুপষ্টভাবে শবকেন্দ্রিক অর্থনীতিকে রাষ্ট্রগুলো মান্যতা দিয়েই দিয়েছে যে কারণে
নেক্রোইকনমি-কে নব্য-উদারবাদী মুক্তবাজার ব্যবস্থারই এক্সটেন্ডেড অঙ্গ হিসাবে গণ্য
করা হচ্ছে। ধনবাদের নিয়ন্ত্রণে প্যালেস্তাইন যুদ্ধ জারি রয়েছে এবং সেই পটভূমিতে
জীবনধারণের প্রয়োজনে কাজে যোগ দেওয়ার বিষয়ে বলা হচ্ছে যে কাজ করার এই বাধ্যবাধকতা
আদতে মৃত্যুমুখী হওয়ার সামিল কিন্তু বেকারত্ব-সৃষ্ট দুর্দশার চেয়ে কাজে যোগ দেওয়ার
ব্যাপারটিকে অপরিহার্য এবং কাম্য মনে করা হয়। প্যাণ্ডেমিকের কারণে সেই ধরনের কাজের
কাঠামোগত কাঠিন্য যদিও আরো বেড়ে গেছে।
সারা
বিশ্ব বস্তুত কোভিদ-১৯ প্যাণ্ডেমিকের দুর্যোগে মৃত্যু-কবলিত হয়ে পড়েছে। দুহাজার
কুড়িকুড়িতে অসংখ্য মার্কিনী মানুষ আমেরিকায় প্রাণ হারি্যেছিলেন আর বর্তমান বছরে
ভারতে এই রোগ মহামারীর আকার ধারণ করেছে। মার্কিনী কোভিদ-১৯ সংক্রমণের পর্যালোচনা
করে দারিয়ান লিখেছেন যে ২০১৬-১৮ সালে আমেরিকায় ঘটমান opioid মহামারীর
সঙ্গে ২০২০-র কোভিদ অতিমারীর তুলনাত্মক বিশ্লেষণ করে নাগরিকদের স্বাস্থ্যের বিষয়ে
যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন না করেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের তড়িঘড়ি লকডাউন তুলে নেওয়ার
সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে এই জনবিরোধী প্রবণতাটিকে 'necroeconomy'
আখ্যা দিয়েছেন। কেননা, তিনি
মনে করেন যে এই ধরনের অর্থনৈতিকতা পদক্ষেপ নেওয়ার পিছনে যেন কিছু মানুষের বাঁচার
অধিকারকে হেয় করা হয়েছে; অর্থনীতিকে সুদক্ষ, সমৃদ্ধ
এবং চাংগা করে তোলার প্রয়োজনে কিছু মানুষকে 'কিলেবল'='বধ'যোগ্য ঠাওর করা হয়েছে। দারিয়ান এমনও মন্তব্য
করেছেন যে opioid মহামারীর প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্তা নেওয়ার
প্রতিশ্রুতিতে ভর করে ট্রাম্প ২০১৬-র নির্বাচনে জয়লাভ করেছিলেন; কিন্তু
প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর সেবিষয়ে কোনো জরুরি পদক্ষেপ নেননি। এবং তারই
ফলস্বরূপ এগারো মিলিয়ন আমেরিকান opioid প্রেসক্রিপশনের অপব্যবহার করেছিলেন। ২০১৮
পর্যন্ত প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রায় ৪০০০০০ মানুষ এই মহামারীর কবলে পড়ে মারা
যান। ইকনমিস্ট পত্রিকার বয়ান অনুযায়ী এতো মানুষের মৃত্যু, বস্তুত, দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধ বা কোরীয় যুদ্ধ বা ভিয়েতনাম যুদ্ধে নিহত যোদ্ধাদের মিলিত সংখ্যার থেকে
বেশি ছিল।
ট্রাম্পসাহেব
আদতে জীবনহানির বিনিময়ে কাজে ফিরে যাওয়া এবং অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের বিষয়টির মধ্যে
ফারাক-পার্থক্যের মাপজোক করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ট্রাম্পকে কয়েকধাপ ছাপিয়ে ব্রিটিশ
প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন প্রাথমিক পর্যায়ে “herd
immunity” বা আক্রান্তের প্রতিরোধ
শক্তিকে পশুর প্রতিরোধ শক্তির সঙ্গে তুলনা করে কোভিদ-১৯ ভাইরাসের বিরুদ্ধে কোনো
প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলার ব্যবস্থা করেননি,
যদিও অসংখ্য জীবনহানির
পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। দারিয়ান স্মিথ লিখেছেন যে ট্রাম্প ভাইরাসটিকে একটি
চূড়ান্ত ধাপ্পাবিজি বলে অভিহিত করে কার্যত অবহেলা করেছিলেন। কেবল তাই নয়, ট্রাম্প
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে মার্কিনী সমর্থন তুলে নেন এবং সবরকমের সহযোগিতা
প্রত্যাহারের কথাও ঘোষণা করার পাশাপাশি চটজলদি মার্কিনী অর্থনীতির হাল ফেরানোর
লক্ষ্যে মেডিক্যাল বিশেষজ্ঞদের অভিমত অগ্রাহ্য করে অপরিক্ষীত ওষুধ ব্যবহারের ঢালাও
অনুমতি দিয়েছিলেন। মার্কিনী জনগণ স্বভাবতই বিস্ময়ে শিউরে ওঠেন। লক্ষ লক্ষ মানুষের
প্রাণনাশ ঘটে। দারিয়ান স্মিথ লিখেছেন যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এমন মনোভঙ্গির
প্রভাব পড়ে বাকি বিশ্ব নেতাদের মধ্যে,
যাদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন
রাশিয়ার পুটিন, ভারতের নরেন্দ্র মোদি,
ব্রাজিলের বোলসোনারো আর
ব্রিটেনের বরিস জনসন (সূত্রঃ-ইভ দারিয়ান স্মিথ ,'ডায়িং ফর দি ইকনমি')।
আর নজর কেড়ে নেয় ফ্রিডম্যানের মন্তব্য যে "এর থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি
যে অতিমারীর মোকাবিলায় জাতীয়তাবাদী ডানপন্থিদের ব্যর্থতা ভয়ঙ্কর... ডানপন্থিরা যে
মানুষের বিষয়ে ভাবনাচিন্তা করেন, সেই মিথ
আদতে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল (সূত্র-তদেব)।
এমুহূর্তের ফেবুবিশ্বে ভারতীয় কোভিড–চুল্লির দগদগে হুতাশন। সংবাদপত্রের প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় বা চতুর্থ-পঞ্চম পাতা জুড়ে পিছমোড়া অগুণতি লাশের হৃদয়বিদারক দৃশ্য। অথচ, প্রথম কোভিদ ওয়েভে ভারত যেন নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিল। করালগ্রাস শব্দটিকে কলেজজীবন থেকেই ব্রাত্য করে রেখেছিলাম। কিন্তু, করোনার দ্বিতীয় ওয়েভ সত্যিকারের পরিস্থিতিটি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। ভুল ভাঙছে। সেকেণ্ড ওয়েভের করোনাবিশ্বে ভারতের স্থান জগতের মধ্যে এখন অব্বল নম্বরে। পুরো ভারতের কথা বরং থাক। আর্থ-সামাজিক বিষয়ে আমরা নিজেদের অতি সচেতন বলে মনে করি, কিন্তু অর্থনৈতিক বিচার-বিমর্ষ ছাড়াই ধর্মের ভিত্তিতে রাজনৈতিকতার নীতি নির্ধারণ করি। এমনই আদতে পশ্চিমবঙ্গীয় দুহাজার একুশের জাগ্রত পরিমণ্ডলে। আওমরা জানি ও বিশ্বাসও করি যে হিস্ট্রি রিপিটস্। সংসদীয় রাজনীতিতে, ধর্মীয় অনুষঙ্গে, রাষ্ট্রনীতির ভাগ্য নির্ধারিত হচ্ছে, হাঃ—এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি!!! অতি বিরল ঘটনা। আবার লিখি, ব্রিটেন থেকে আমরা পার্লামেন্টারি ডেমোক্রাসি আমদানি করেছিলাম। কিন্তু মজার ব্যাপার হল আমরা ভাল কপিক্যাট নই। টুক্লিটাও ভালো করে করতে শিখিনি। অতএব, প.বাংলাই একমাত্র গণতান্ত্রিক উত্তরাধিকার, যেখানে ধর্ম-অধর্মের বাগবিতণ্ডা-বিশ্লেষণে—রাষ্ট্রীয় ভাগ্য, দু-দুবার, নির্ধারিত হয়। সে ১৯৪৭-ই হোক বা ২০২১। হয়তো এই উচ্চারণটিকে কেউ অপ্রাসঙ্গিক–অনভিপ্রেত-অবিবেচনাপ্রসূত মনে করতেই পারেন। কিন্তু অর্থনীতি অবশ্যই একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। প্রমাণ? ডিমনিটাইজেশন = বলা হচ্ছে যে নভেম্বর, ২০১৬-র এই হঠকারী পদক্ষেপ ভারতীয় অর্থনীতি থেকে ৮৬% টাকা শুষে নিয়েছিল। অর্থ হয়, প্যান্ডেমিকের বহু আগেই ভারতীয় অর্থনীতি ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে পড়েছিল। ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট কমেছে। ইকনমিক টাইমস্ জানাচ্ছে (১৯/২/২০২০-সূত্র, গুগল) সেভিংস রেট (সঞ্চয় প্রবৃত্তি) গত পনেরো বছরের মধ্যে সবচেয় কম। পাশাপাশি, ইনভেস্টমেন্ট রেট ২০০৮-এর (৪০%) থেকে ২০১২-১৩ পর্যন্ত ৩৫+ -এর আশেপাশে থাকলেও ২০১৬-১৭-য় অধোমুখী হয়ে পড়ে। ঠিক তেমনই রপ্তানিবাণিজ্যে ভারতীয় পণ্য ২০০৩-এর শতকরা ১০ থেকে ২০১২-১৩য় ১৬% -এর চড়াই পার করে এখন নিম্নমুখী ফের। কাজের সন্ধানে অজস্র বাঙালি গত দু’তিন দশক ধরে কাজের বাজার না থাকায় প্রবাসজীবন বরণ করে নিতে বাধ্য হয়েছিল। করোনা ধাক্কায় সে গুড়েও বালি পড়ল। কাজকর্ম ছেড়ে সবাই ঘরমুখো হলেন। আনএমপ্লেয়েবল তকমাটি হাওয়ায় ভেসে উঠল। করোনার মতোনই এটিও একটি মারণ-ভাইরাস। যারা ঘরে ফিরে এসেছে তারা হেথা অথবা হোথা—কোথাও চাকুরি পাওয়ার যোগ্য নয়, কাজের বাজারই বা কই? তাই ওরা আনএমপ্লয়েবল। মৃতসৈনিক ওরা। উদ্বৃত্ত। মুমূর্ষু ওরা– বর্জ্য।
এমতাবস্থায়, বিচার্য
বিষয় হলঃ—১)করোনার প্রথম ওয়েভ আসার ঢের ঢের আগে 'ডিমনিটাইজেশন'
নামক এক অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নিয়ে এবং মাত্র চার ঘন্টার নোটিশে
রাষ্ট্রব্যাপী লকডাউন ঘোষণা করে লাখোলাখো পরিযায়ী শ্রমিকের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে
তাদের অনাহারে-অর্ধাহারে মৃত্যুর মুখের ঠেলে দেওয়ার সূত্রে সরকার কি ভারতরাষ্ট্রে
নেক্রো-ইকনমি জাতীয় পদক্ষেপ নিয়েছিলেন?
বস্তুত, পরিযায়ী
মানুষজন জানেন যে অনুমতি লাগে না এক্সিটের;
যেহেতু জন্মমাত্রই
প্রস্থানের নির্দেশ ঠুসে দেওয়া হয় ললাটে—খুদে এক হোর্ডিং, নশ্বরতা।
২)করোনার
'দ্বিতীয়
ওয়েভের ক্ষেত্রে 'লকডাউন' ঘোষণার বিষয়ে যথেষ্ট গড়িমসি করে এবং দেশীয়
স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে অতিমারী মোকাবিলার উপযুক্ত পন্থা অবলম্বন না করায় আমাদের
দেশীয় শাসকবৃন্দ কি নেক্রোপলিটিক্সের অনুগামী হলেন না? সংবাদপত্র
ও টেলিমিডিয়ার রিপোর্ট সূত্রে অনুমান করা যেতেই পারে যে, যথাযথ
প্রস্তুতির অভাবে, কোভিডের দ্বিতীয় ধাক্কাটি সামলাতে ভারতবর্ষ বস্তুত একদমই
ব্যর্থ হয়েছে। ব্রিটেনের বরিস জনসন বরং নিশ্চিতই যথেষ্ট সাফল্য লাভ করেছেন এ
বিষয়ে। পনেরোই মার্চ ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে বহু মানুষের কলরোল শোনা ও দেখা গ্যাছে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যেভাবে আগাম সতর্কবার্তা সত্ত্বেও কোভিদ মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়ে
লাখ লাখ মার্কিনী জনতাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন, ঠিক
তেমনই, যথেষ্ট সময় পাওয়া সত্ত্বেও,
শাসনতান্ত্রিক অকর্মণ্যতার
জন্যই ভারতবর্ষের অগুণতি মানুষ এও বছর কোভিদ অতিমারীর শিকার হয়েছেন। এ বিপর্যয়
অবশ্যই এড়ানো যেত।
মগজের ভেতর দিয়ে ধুমধারাক্কা ইয়াস বয়ে গেল যেন।
ReplyDelete