আমরা 'প্রথম কাব্যির পরশ' বিভাগে উপস্থাপন করি কবির প্রথম কাব্যকে, ‘তারুণ্যে’র কবির প্রথম কাব্যকে। এ দফার উদযাপনে রইলেন কবি বিশ্বজিৎ বর্মন। আলোচনায় কাজী রুনালায়লা খানম।
'পিথাগোরাসের ভূখণ্ডে' নিবিষ্টভ্রমণ: কাজী রুনালায়লা খানম
কবিতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে পি বি শেলী বলেছেন, “কবিতা পরিতৃপ্তির বিষয়। কবিতা তখনই সার্থক হয়, যখন কবিমনের পরিতৃপ্তিতে পূর্ণতা আসে।” তাঁর ভাষায় বোঝানো হচ্ছে, কবিতা হলো মানুষের পরিতৃপ্তির বিষয়। মানুষের মনের ভাব প্রকাশের শ্রেষ্ঠ মুহূর্তের বিবরণ হচ্ছে কবিতা। কবি জনসন বলেছেন, “কবিতা হলো মেট্রিক্যাল কম্পোজিশন। আনন্দ ও সত্যকে মেলানোর শিল্প, যেখানে রিজনকে সাহায্য করার জন্যে ইমাজিনেশনের ডাক পড়ে।" কবি হুমায়ুন আজাদের মতে, “যা পুরোপুরি বুঝে উঠব না, বুকে ওষ্ঠে হৃৎপিণ্ডে রক্তে মেধায় সম্পূর্ণ পাব না, যা আমি অনুপস্থিত হয়ে যাওয়ার পরও, রহস্য রয়ে যাবে রক্তের কাছে, তার নাম কবিতা।”
বিশ্বজিতের কবিতার বই 'পিথাগোরাসের ভূখণ্ড' পড়তে পড়তে আমার মনে হয়েছে ওপরের সব ক’টি কথার সঙ্গে কি দারুণ সাবলীলভাবে মিলে গেছে বিশ্বজিতের কবিতারা। বিশ্বজিৎ বর্মন। পেশায় শিক্ষক। কবিতার সাথে তার দীর্ঘবাস। অনেকদিন আগেই বইটি উপহার হিসেবে পেয়েছি কবির কাছ থেকে। আজ তার কবিতা নিয়ে দু’চার কথা বলার চেষ্টা করছি। নামকরণের মধ্যে একটা জ্যামিতিক ভাবনার বিন্যাস। বৃহত্তর জীবনক্ষেত্রকে বিভিন্ন আঙ্গিক থেকে জ্যামিতিক অবয়বে দেখতে চেয়েছে বিশ্বজিৎ। এবং ভিন্ন ভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে সমাজের, জীবনের, সম্পর্কের যে কোলাজ ধরা পড়েছে তার সন্ধিৎসু চোখে তারই সুনিপূণ রেখাচিত্র ফুট উঠেছে কবিতাগুলিতে। এবার আসি প্রচ্ছদে। বিশ্বজিতের ‘পিথাগোরাসের ভূখণ্ডে’র প্রচ্ছদও নির্মিত হয়েছে জ্যামিতিক চিত্রে। অনন্ত নীলের ওপর ভাসমান অর্ধবৃত্তাকার ইমেজে বিভিন্ন উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার যেন মনে করায় অনন্ত জীবনপ্রবাহে মানুষের ছোট ছোট যাপনের জলছবি। যার মধ্যে মিশে আছে উজ্জ্বল অনুজ্জ্বল মুহূর্তের ফুলকারি। বিশ্বজিৎ তার কাব্যে খুব সচেতনভাবেই শব্দের প্রয়োগ করেছে। গ্রাম্য স্বল্প পরিচিত শব্দের সাথে আগন্তুক শব্দ, চলিত রীতির শব্দের সাথে সাধু রীতির মিশ্রণ ঘটিয়েছে অনায়াসে। ব্যাকরণের ধরাবাঁধা পথে না হেঁটে সাবলীলভাবে ভেঙে দিয়েছে ক্রিয়াপদের বিশেষণের প্রচলিত কাঠামো। কিন্তু পুরো কাব্যগ্রন্থটা পড়ে এসে কোথাও কৃত্রিমতা খুঁজে পাওয়া যাবে না। মনে হবে এই ভাঙাচোরা এই ফার্সী হিন্দী শব্দের প্রয়োগ এই গ্রাম্য শব্দের প্রয়োগ সবই কবিতাকে ঋদ্ধি দেওয়ার জন্যই।
'পিথাগোরাসের ভূখণ্ডে' ভ্রমণ করতে করতে যেটুকু অনুভব করলাম বিশ্বজিতের কবিচেতনা ভ্রাম্যমান। মুমুক্ষুর মানসযাত্রা। একটি কবিতা উদ্ধৃত করতে চাই আগ্রহী পাঠকের জন্য—
"লালনদেহ জলে নামছে, তোমার দেহে পালকগন্ধ, পালক খসাও
জল দাও, দেহে ধরি
নীলাচল পথ, সুড়ঙ্গ"
আবার সংসারের বন্ধনকেও পুরোপুরি অস্বীকার করতে পারেনা। পরের অংশে যখন সে লেখে—
"পায়ে লাগাম, ছুটতে পারি না গো, মেদিনী দাও
উড়ন্ত বাতিঘর নাও
উঠোনে শুয়ে নেতিয়ে আছে
অশ্বমেধের ঘোড়া, ম্যাপ ও সুড়ঙ্গ"
একটা বিষয় লক্ষ্য করলাম কবি সুড়ঙ্গ শব্দটিকে বারবার ব্যবহার করেছেন নানা অনুষঙ্গে। তাহলে কি কবি কোনো 'আশ্চর্যজনক রাস্তা'য় হাঁটতে চেয়েছেন প্রাত্যহিকতার বাইরে, ভিন্নতর কিছুর সন্ধানে? বাউল, গোঁসাই, বাঁশি শব্দগুলোর পুনরাবৃত্তি মনে করায় রূপসাগরের প্রতি কবির অমোঘ টানের কথা! কালকেতু ফুল্লরা কিংবা চাঁদ সওদাগর বেহুলার প্রসঙ্গ আমাদের টেনে নিয়ে যায় মাইথোলজির আলোআঁধারিময় প্রাঙ্গনে।
বিশ্বজিতের কবিতায় যৌনতা আছে, জরায়ুযন্ত্রণার কথা আছে, বৈধব্য আছে, পুরুষের নিষিদ্ধ চাওয়া আছে তবে তার উদগ্র প্রকাশ নেই। বরং সবটাই সিম্বলিক। একটি কবিতা—
"সোহাগী আপেলের নাভিতে ঘোড়ার টগবগ, খাতিরদারি
তুমি কোথায় পালাচ্ছো শিরোনামহীন
ইস কেন যে পান থেকে চুন খসালাম
আরও চুনের গল্প আছে পানের পাতার ওপর
চুপ গল্পে নিউটনের আপেল পড়ছে ধুপধাপ
শুধু টানটান, বিবিজান, মিশতে দে"
‘পিথাগোরাসের ভূখণ্ড’ কেন আপনাকে আকর্ষণ করবে তার জন্য কয়েকটি কবিতা তুলে দিই মনস্বী পাঠকের জন্য।
'উচ্চারণ, ফুঁ' কবিতায় কবিসত্ত্বার টানাপোড়েন কিংবা আবহমানের বেদনার গোপন কথাটি পড়তে গিয়ে পাঠকমনেও একটা 'খোঁজ' চলবে
"আলজিভে আটকে আছে উচ্চারণ, ফুঁ উচ্চারণে
ভেঙে যাচ্ছে বসতবাড়ি
আস্তে এসো প্রতিটি ফুঁ বরফযুগ পেরিয়ে সাবালক একটি ফুঁ মিশে যেতে চাইছে বাঁশিতে
আমি ফতুর গোঁসাই, ফুঁ ভরছি বাঁশিতে"
'রোদপুকুর' কবিতাটিতে নষ্ট সময়ের সিম্বলিক ছবি—
"দুপুর ভেঙে তুমি চিরুনিতল্লাসি, রাহাজানি, রক্তহজম
খুঁজো করোটিকঙ্কাল, কাঠামোবুক, ভাসান
কম্পাসে ঝোলে হৃদয়দৌড় একফালি দু’ফালি
শিরদাঁড়া শোয় রোদপুকুরে, জলবিছানা দাও, ঘুমোক"
অন্য একটি কবিতায়—
"তুমি জন্মাও, জন্মাও আকন্দফুল, ভেতরে ভেতরে নিষিদ্ধ দাঁড়াচ্ছো শিবের ওপর
ক্ষতদিন, আমিও আলপিন জন্মাই, জন্ম দাও"
গার্হস্থ জীবনের নিটোল ছবি নিপূণ এঁকেছে বিশ্বজিৎ শেষ কবিতায়—
"সমস্ত তারা ঝরে গেলে দু'ভাই মিলে রাত ভাগাভাগা করে নিই
আঙিনায় বাষ্প ছড়িয়ে মা মিহিশব্দ, ভেসে যায়, ফুল ফোটে
পায়ের পাতায় দু'ভাই, পদ্ম ফোটে
রাতজুড়ে মায়ের চোখ দুটো শীতলপাটির গান হয়ে যায়"
কাব্যগ্রন্থটি পড়তে পড়তে পাঠকেরও বুক জুড়ে শীতলপাটি গান হয়ে বেজে যাবে নিশ্চিত। বিশ্বজিতের কবিতারা দীর্ঘ নয়। ছোটো ছোটো ছাপ্পান্নটি কবিতায় সাজানো হয়েছে 'পিথাগোরাসের ভূখণ্ড'। শব্দ প্রয়োগের নতুনত্ব বিশ্বজিৎকে আলাদাভাবে চেনায় 'পাখিঘুম', 'নিতম্বসকাল', 'রোদগমন', বৈষ্ণবীদিন', 'লালনফুল', 'সুতোজল', এই ধরনের আনমোল কিছু শব্দ ছড়িয়ে আছে 'পিথাগোরাসের ভূখণ্ডে'। আশা করছি মননশীল পাঠকমনে জায়গা করে নেবে 'পিথাগোরাসের ভূখণ্ড'।আলোচিত কাব্য:
কবি-পরিচিতি:'পিথাগোরাসের ভূখণ্ড'
কবি: বিশ্বজিৎ বর্মন
প্রচ্ছদ: মারুত কাশ্যপ
প্রকাশক: চারণ প্রকাশন, কলকাতা
মূল্য: ৯০ টাকা
যোগাযোগ: ৯৮৩২৩৪৪৩৭১
বিশ্বজিৎ বর্মনের প্রথম কাব্য 'পিথাগোরাসের ভূখণ্ড' ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয়। প্রকাশক—চারণ। কবির জন্ম ১৯৮৫ সালে আলিপুরদুয়ার জেলার (তৎকালীন জলপাইগুড়ি) এক ক্ষুদ্র জনপদ রাঙ্গালিবাজনায়। লেখালেখি শুরু শূন্য দশকে। লেখেন বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন ও ওয়েবজিনে। ইদানীং বছর দু’চার ধরে অবশ্য লেখালেখিতে ভাটা। ‘কষ্টিপাথর’ পত্রিকা সম্পাদনায় যুক্ত ছিলেন।আলোচক:
কাজী রুনালায়লা খানম, কবি, প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ 'যে বাঁশি পোড়ালো চোখ' (২০১৮)।
No comments:
Post a Comment